জীবন চক্র

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

sakil
মোট ভোট ৬৯ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.৮৭
  • ৬৬
  • ৫৭
গ্রীষ্মে
বৈশাখ মাসের রোদেলা দুপুর।আম গাছের নিচে পাতা মাচানে বসে পান চিবুচ্ছেন রহম আলী। সারাদিন কলা বাগানে খেটে এসেছেন। নিজের এক চিলতে জমিন। তার উপর ভরসা করে চলতে হয় পুরো বছর। কোন কোন বছর বেশ ভালো চলে । আর কোন কোন বছর অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। এসব সব উপরে ওয়ালার খেলা বলে মানেন রহম আলী।
বাপ মারা গেছে সেই ছোট বেলায়। মা জন্মের সময়। সেই থেকে ফুফুর বাড়ীতে মানুষ হতে হতে নিজের বাড়ী হয়ে গেছে অশ্বথতলা গ্রাম। গ্রামের এই নামের পেছনে ছোট একটা ইতিহাস আছে। গ্রামের ঠিক মাঝ খানে একটি অশ্বথ গাছ আছে । যার বয়স সঠিক কত তা কেউ জানে না । সকলে ধারনা করে এই গাছটির উপর ভিত্তি করে কেউ হয়ত এই গ্রামের নাম রেখেছে অশ্বথতলা । সেই কারনে প্রতি বছর বৈশাখী মেলা এই অশ্বথ গাছের তলায় হয়। বাড়ীর পাশে মেলা হলে ও সেখানে তেমন একটা যেতে পারেন না রহম আলী।
সংসারে এক মেয়ে আর দুই ছেলে । বউ গত হয়েছে চার বছর হল। বড় ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ী থাকে ঘরজামাই হয়ে । ছোট ছেলে বাজারের হোটেলে কাজ করে । মাঝে মাঝে সংসারে কিছু দেয় । মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়ে আসছে । সে ব্যাপারে রহম আলীর যত চিন্তা । এবারে কলা'র ফসল সহিসালামতে তুলতে পারলে মেয়েটার একটা ব্যাবস্থা করবেন বলে মনে মনে স্থির করেছেন। বাঁশের মাচানের উপর বসে আনমনে এসব ভাবছিলেন রহম আলী । কখন যে তার মেয়ে জয়নাব এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই খেয়াল নাই।
ও বাবা !কি ভাব?
কিছু নারে মা (চমকে উঠে )
খানা খাইতে আস।
হ্যাঁ আইতাছি , তুই যা।
ঠিক আছে বাবা। জলদি আইসো কিন্তু।
রহম আলী খেতে বসেছেন। তার সামনে কিছু ভাঙ্গা চাউলের (খুদ)ভাত ।সাথে হেলেঞ্চা শাক। এই খাবার বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে রহম আলী । খাবার নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই ।যেদিন যা জোটে তাতেই খুশী। কিন্তু মেয়েটার জন্য কষ্ট লাগে। কিছু কষ্টের কখনো প্রকাশ হয় না , যা নিজের মনে থেকে যায়। হেলেঞ্চা শাকে লবন বেশী হয়েছে কিন্তু তিনি কিছুই বলছেন না । মা মরা মেয়ে , কষ্ট করে পাকায় তাইতো বেশী।
জয়নব মা , একটি শুকনো মরিচ দে।
মরিচ তো নাই বাবা। আজ তো মরিচ চাড়া পাকিয়েছি।
আচ্ছা লাগবে না মা। বিকালে বাজারে গেলে মনে করে দিস। মরিচ নিয়ে আসব।
ঠিক আছে মনে করিয়ে দেব।
গ্রীষ্মের দাবদাহে চারদিক অনেক শুষ্ক।পাকা আমের ঘ্রান সারা গ্রামময়। পড়ন্ত বিকেলে নিজের কলা বাগানে কাজ করছে রহম আলী। আগাছা পরিস্কার করছে , সার দিচ্ছে বড় এবং মোটা গাছ গুলো কে বাঁশের খুটির সাথে আটকে দিয়েছে । যাতে করে ঝড় তুফান এলে কলাগাছের কোন ক্ষতি না হয়। ভয় শুধু কালবৈশাখী কে। কলাবাগানের কলা বেচে ব্যাংকের ঋণ শোধ দিতে হবে, তারপরে মেয়েটার বিয়ে । এসব ভাবতে ভাবতে সময় পার হয়ে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে প্রতিদিনের মত আজো বাজারে যাওয়ার কথা ভুলে যায় রহম আলী।
রাতে বাড়ী ফিরে এলে মেয়ের প্রশ্নে বাজারে যাবার প্রসঙ্গ মনে হয় রহম আলীর। সন্ধ্যার পর থেকে ঝড়ো হাওয়া বইছে। রহম আলী ভীষণ চিন্তিত। মেয়েকে ঘুমিয়ে থাকার কথা বলে নিজে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে । সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস বইছে। বাড়ির পাশের সুপারি গাছের মাথা গুলো নুয়ে মাটি ছুঁতে চায়। রহম আলী বুঝে এবার সব শেষ । কলা বাগান বুঝি আর রক্ষা পেল না। ছুটে চলেন কলা বাগানের দিকে। ঝড়ের ঝাপটায় বেশ কিছু কলা গাছ ভেঙ্গে গেছে। রহম আলী পাগলের মত হয়ে এদিকে সেদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। তার মেয়ে জয়নাব কখন কলা বাগানে চলে এসেছে তা তিনি খেয়াল করেননি। বাপ বেটি মিলে সর্বনাশ ঠেকাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কালবৈশাখী কি তাদের আকুতি শুনে। প্রায় চার ঘণ্টার তাণ্ডব লীলার পর কালবৈশাখী ঠাণ্ডা হল রহম আলীর কলাবাগানের চরম সর্বনাশ করে। রাতের বেলায় কলা বাগানের পাশে বসে বিলাপ করতে লাগল রহম আলী ।
আমার সব শেষ হয়ে গেছে খোদা, আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
জয়নাব বহু কষ্টে তার বাবাকে একরকম টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে এল ।


বর্ষায়
বর্ষার বর্ষণে গ্রামের রাস্তা ভিজে একাকার। ঘর থেকে বাইরে বেরুলে শুধু কাদা আর কাদা। পায়ে ঘা হয়েগেছে মমিন মিয়ার। ঘরে বসে থাকলে তার চলে না । তাই প্রতিদিন কাদামাটি মাড়িয়ে গঞ্জে যেতে হয় । আর যাওয়া আসা করতে করতে পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে সাদা হয়ে কেমন বিশ্রী ঘা হয়ে গেছে। রাতের বেলা ঘুমাতে গেলে বেশ চুলকায়। ইদানীং হাতের চামড়া গুলো কেমন খসখসে হয়ে গেছে। ছনের চাউনি দেয়া ঘরে মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ে। সারের কাগজ (পলিথিন) গুজে দিয়ে পানি পড়া বন্ধ করেন প্রায় প্রতিদিন।
মমিন মিয়ার ছেলের বউ সুমি কদম ফুল দারুণ ভালবাসে। বর্ষা এলে পুকুর পাড়ের কদম গাছে অজস্র ফুল ফোটে, কদমের সুভাস অন্যরকম এবং আকর্ষণীয়। ঘরে খাবার চাউল নেই , বউয়ের কদম ফুল প্রীতি দেখে শাশুড়ির মেজাজ চড়ে যায়। নতুন বউ বলে কিছু বলেননা। এদিকে নিজের মেয়েটা সারাদিন বউয়ের সাথে কি সব বকবক করে কথা বলে তিনি তা জানেন না। বিড়ির ঠোঙ্গা গুলো নিজে একাই বাধেন। দুজনে হাত লাগালে তো বেশ হয়। অভাবের সংসার তাই বিড়ি বাধার কাজ করেন মমিনের স্ত্রী । দিনে চার পাঁচ হাজার বিড়ি বেঁধে পনের বিশ টাকা আয় করেন। সেই বিড়ি নিয়ে প্রতিদিন গঞ্জের কারখানায় যেতে হয় মমিন মিয়াকে।
বড়ছেলে ঢাকায় থাকে , গার্মেন্টসে কাজ করে । যা বেতন পায় তাতে নাকি তার নিজের চলে না । মাঝে মাঝে কিছু টাকা দেয় তাতে কিইবা হয়। ছোট ছেলে আজিজ মানুষের বাড়িতে কামলা খাটে। বলতে গেলে তার রুজিতেই সংসার চলে। শান্ত ছেলে। কারো প্রতি কোন অভিযোগ নাই। বর্ষায় মাঠে কাজ কর্ম নাই , তাই পাশের গ্রামের নজু মুন্সির ছেলের সাথে নৌকা বায়। সকালে যায় রাতে ফিরে, কোন কোন দিন ফেরে না ।
ছেলেটার বিয়ে দিতে হবে । কিন্তু মমিন মিয়া ভয় পান। একেতো সংসারে অনেক লোক। কাজের লোক তো বলতে গেলে আজিজ । তাই অপেক্ষা করে সুদিনের । সেই সুদিন কবে আসবে তা তার জানা নাই ।
গঞ্জ থেকে ফেরার পথে বিলের মাঝে শাপলা ফুল দেখে এই বৃদ্ধ বয়সে মমিন মিয়া নেমে যান বিলে। লুঙ্গিটা কাছা মেরে বিচিত্র ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে বিলের মাঝ থেকে অনেক গুলো শাপলা তুলে নেন। বাড়িতে এসে ছেলের বউ কে দেখেন কদম ফুল খোঁপায় জড়িয়ে বসে আছে ঘরের দাওয়ায়। তার হাতে শাপলা ফুল দিয়ে বলেন
নাও মা এগুলো এই বেলা রেধে ফেল।
জি বাবা বলে বউ শাপলা নিয়ে ঘরের ভেতর পা বাড়ায়।
শোন এখানে দুইটা রেখে যাও। আর একটু লবন দিয়ে যাও। কাঁচা শাপলা লবন দিয়ে খেতে বেশ লাগে। বউ খেয়েছ কখন।
হ্যাঁ বাবা খেয়েছি ছোট বেলায়।


শরৎ -এ
স্কুলের পাশে ছোট খাল । তার পাশে অনন্য সুন্দর এক কাশবন। কাশফুলে ছেয়ে আছে খালের পাড় । নিচে সবুজ কাশ উপরে ধব সাদা কাশফুল। কাশবনের পাশে মীর'দের জমি। সেই জমিতে ধানের চারা লাগাচ্ছে আজিজ। গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর মনের আনন্দে ধানের চারা রোপন করে যাচ্ছে। সাথে অন্যান্য দিনমজুররা বেশ মজা পাচ্ছে। আজিজ সাথে থাকলে তাদের কাজে বেশ সুবিধা। আজিজ নিজের কাজ করে তাদের কাজে ও হাত লাগায় সাধ্যমত। আজিজ বিড়ি সিগারেট খায়না তাই মালিকের দেওয়া বিড়ি তাদের ভাগেই যায়। এর প্রতিদান হিসাবে নাস্তা খাবার সময় আজিজকে একটি রুটি বেশী খেতে দেয়। আজিজ খেতে চায় না কিন্তু তারা জোর করে খাওয়ায়।
মীর'দের অনেক জমি । এই গ্রামে তারা অনেক বড় গৃহস্ত। বেশ জমি আছে। মীর বাড়ির ছেলেরা সব দেশের বাইরে থাকে । তাদের গোমস্তা নিরঞ্জন সবকিছু দেখাশুনা করে। নিরঞ্জন লোক ভাল এবং সৎ । সে কারনে মীর পরিবার তাকে বিশ্বাস করে। প্রতিবছর যা ধান চাউল হয় সব হিসাব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিয়ে আসে শহরে গিয়ে। বিনিময়ে নিরঞ্জন আছে বেশ বহাল তবিয়তে। কাজ শেষ করে নিরঞ্জন থেকে টাকা নিয়ে গঞ্জে যায় আজিজ । ঘরে তার মা ,বোন,বাবা এবং ভাবী তাদের জন্য সওদা পাতি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। গ্রামের রাস্তায় সন্ধ্যা নামলে যেন ভুত নামে । ঘর থেকে তেমন কেউ বাইরে বেরুয় না। সেই সন্ধ্যা রাতে বাড়ি ফেরার সময় ভয় ভয় লাগে আজিজের। দেখতে যতই জোয়ান পুরুষ হোক না কেন ভেতরে ভেতরে সে একটা আস্ত ভীতু । সেদিন রাতে গঞ্জ থেকে ফিরছে একা একা । কাশবন থেকে শেয়ালের হুয়াক্কা হুয়া ডাক ভেসে আসছে। এই শিয়ালের ডাক শুনলে তার এমনিতেই ভয় লাগে ।
সে সময় কে যেন তার শরীরের পাশ ঘেঁষে পেরিয়ে যায়। প্রশ্ন করলে উত্তর ও দেয়না। আজিজ মনে মনে ভয় পায়। পেছন থেকে শুধায়-
কে যায়?
আগুন্তক কোন কথা না বলে দ্রুত হাটে। আজিজের শঙ্কা হয়। চোর ডাকাত নয়তো।সে আবার শুধায় কে ওখানে, কে যায়।
আগুন্তক নিরুত্তর। তবে হাটার গতি বাড়ায়। আমবাশ্যার রাতে আধারে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। সাহস করে আজিজ জোরে হাটে । উদ্দেশ্য আগুন্তক কে ধরা। অবশেষে সফল হয়। যেই হাত ধরে অমনি ছেড়ে দেয়। কারন আগুন্তক পুরুষ নয় মহিলা।
কে তুমি
জয়নাব
কোন জয়নাব , এত রাতে কোথায় যাও।
গঞ্জে গেছিলাম। ফিরতে রাত হয়েগেছে। খেয়া মাঝি ছিলনা । বাবা অসুস্থ ,ঘরে খাওন নাই।
ও আচ্ছা। তুমি রহম চাচার মেয়ে না । তোমার ভাই কোথায়?
সেতো বাড়ি নাই।
চল তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেই।
না লোকে দেখলে কি কইব। আপনি যান। আমার কোন অসুবিধা অইব না।
আরে তুমি আমারে চেন নাই। আমি আজিজ , তোমাদের পাশের পাড়ার। আমি তোমার বাবারে ভালোমত চিনি। ভয়ের কিছু নাই।
এরপর দুজন নির্ভয়ে পথ চলতে থাকে । নিজদের মধ্যে অনেক কথা হয় দুজনের। দুজনে বেশ কষ্টে আছে সেটা বুঝে দুজনেই। দেখতে দেখতে জয়নবের বাড়ি এসে যায়। জয়নব বাবার ভয়ে আজিজ কে ঘরে আসতে বলার সাহস পায় না। আজিজ এতক্ষণের পথচলার কথা ভাবতে ভাবতে নিজ বাড়ির দিকে যেতে থাকে আপন মনে। তবে আজিজের মনে এখন আর শেয়ালের ডাকের ভয় নাই। অন্ধকারে সে দিব্যি সাহসের সাথে চলছে অবলীলায়।

হেমন্তে
চারদিকে ফসল কাটার হিড়িক লেগেছে । গ্রামে এখন অবসরে কেউ নাই। চারদিকে ব্যাস্তময় সময় । যার নিজের জমি আছে সে কামলা দিয়ে ধান কেটে ঘরে তুলছে,যার জমিন নেই সে অন্যের ক্ষেতে কামলা দিচ্ছে। এযেন গ্রাম বাংলার কৃষকের এক মহাব্যাস্ত সময়। নবান্ন উৎসবে মেতে আছে পুরো গ্রামের ছেলে বুড়ো এবং বউ ঝিরা সকলে। কাঁচা ধানের যে ঘ্রান সে স্বচক্ষে না দেখলে বুঝার উপায় নাই। বাড়িতে বাড়িতে ধান মাড়াইয়ের মেশিনের যান্ত্রিক আওয়াজ আর কর্মব্যাস্ত মানুষের কোলাহল সারা এলাকা জুড়ে।
মীর বাড়িতে কাজের চাপ খুব বেশী । আজিজ মীর বাড়ির বান্দা কামলা। অন্য কামলাদের চেয়ে নিরঞ্জনের কাছে তার কদর একটু বেশী। আজিজ নিজে কাজ করে এবং অন্য সকলের কাজের তদারকি করে। সেজন্য নিরঞ্জন বলেছে বাবুদের বলে তাকে স্থায়ী ভাবে কাজে রেখে দেবে। একটা স্থায়ী কাজ হলে আজিজের বেশ ভাল হয়। কেননা যখন কাজ কাম থাকে না , তখন তাকে নানা জায়গায় ধর্না দিতে হয় কাজের জন্য। তাই এবছর বেশ ফুর্তি নিয়ে কাজ করছে আজিজ।
গতকাল বিকেলে জয়নাব'কে দেখেছে মীর বাড়ির দিকে যেতে। ব্যাপার কি জানার জন্য নিরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করে সকালে। নিরঞ্জন বলে
কাম করতে চায়। মেয়েটার জন্য দুঃখ হয় আজিজ। দুই ভাই অসহায় অসুস্থ বাবার খোজ নেয় না। মেয়েটা অন্যের বাড়ি ঘুরে ঘুরে কামকাজ করে বাবাকে নিয়ে বেঁচে আছে কোনমতে।
কাম দিয়েছ?
হ্যাঁ দিয়েছি । বলেছি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত করলেই চলবে। প্রতিদিন দুইসের চাউল আর পনের টাকা দেব। উপুরি দুপুরের খানা এখানে খাবে।
ভালো করেছেন নিরঞ্জন বাবু।
তা তোমার এত খোঁজের কাম কি?
কিছু না । এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর কি।
না বাপু বুঝতে পেরেছি । তা আমাকে বল। দোষ কি । মমিন মিয়ারে বইল্যা দেখি কি কয়।
আজিজ মাথাচুলকাতে চুলকাতে সেই স্থান দ্রুত প্রস্থান করল।
আজিজ ধানের আটি মাথায় নিয়ে এসে দেখে জয়নাব ধান শুকোচ্ছে। কর্মরত জয়নাব কে দেখে আজিজের মনে অন্য রকম দোল খায়। অনেক মেয়ে মানুষ কাজ করে তাই জয়নাবের কাছে যেতে পারেনা আজিজ। ধান শুকানো ধান ভাঙ্গানো সব মেয়েলি কাজ করে মীরা বাড়িতে জয়নাব। জয়নাবের কাজে নিরঞ্জন বেশ খুশী।
দুপুরে রাস্তায় খড় উল্টে দিচ্ছিল আজিজ । এমন সময় জয়নাব কে যেতে দেখে এগিয়ে যায়। জয়নাব আজিজ কে সেদিনের পর থেকে দেখলে লজ্জা পায়। মনে মনে জয়নাব ভাবছে, কেমন গাবুর(শক্তিশালী) বেটা এদিকে আইসতাছে ক্যান।
এই মাইয়া খাড়াও(দাড়াও)
ক্যান?
কতা(কথা) আছে।
কি কতা ।
বোঝ না । কি কতা
না বুঝি না। কতা কইলে বাড়িত যাইয়েন ।

আজিজ জয়নাবের গমন পথের দিকে চেয়ে থাকে । জয়নাব নিজ বাড়ির দিকে চলে যায়। প্রতিদিন দুপুরের খাবার সে তার বাবা রহম আলীর সাথে খায়। নিরঞ্জন বাবু যেদিন প্রথম দেখলেন সেদিন বাবুর্চি কে বলে দিয়েছেন মেয়েটাকে ভাত আর সালুন একটু বাড়িয়ে দিতে।

শীতে
রহম আলী এখন দারুন সুস্থ । মেয়েটা তার জীবন বাঁচিয়েছে। কষ্ট করে হারামজাদা ছেলে গুলোকে মানুষ করার চেয়ে আমার মা মরা মেয়ে জয়নাব অনেক ভালো। মনে মনে কথাগুলো ভাবছেন আর চেনীতে ধার দিচ্ছেন রহম আলী। এখন তার অনেক কাজ । এই মৌসুম টা ভালোয় ভালোয় গেলে কিছু পয়সা আসবে হাতে। তখন মেয়েটার জন্য ব্যাবস্থা করা যাবে। এতে না হলে শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে দিতে দ্বিধা নাই রহম আলীর। মেয়েটা তার জীবনবর কষ্ট করে গেল সুখের দেখা পেলনা । বিয়ে শাদীর পর যদি আল্লাহ সুখ দেয়? আপন মনে চেনী ধার দিচ্ছেন আর ভাবছেন রহম আলী। শীত এলে তার এই কাজ। খেজুর গাছ কাটা। খেজুর গাছ কেটে তার থেকে রস সংগ্রহ করে রহম আলী শীতের পুরো মৌসুম। গ্রামের সকল গৃহস্ত সবাই এই সময় খোজ নেয় রহমের। যার যার খেজুর গাছ আছে তারা খোজ নেয় গাছ চিলার জন্য । আর যাদের গাছ নাই তারা খেজুরের রসের জন্য। তাই বছরের এই সময়টা রহম আলী নামে একজন এই গ্রামে আছে সেটা বুঝা যায়। কেউ মসজিদে শিরনী দেবে, কারো ছেলে মেয়ে শহর থেকে এসেছে কাচা খেজুরের রস খাবে । এমন নানা কাজে রহম আলী তখন অশ্বথতলা গ্রামের এক মহা ব্যাস্ত মানুষ।
প্রথমে খেজুর গাছের ডাল গুলো সাবধানে কেটে ফেলতে হয়। কোমরে একটা বাশের বানানো ঝুড়িতে কাঠের হাতুড়ি , দুই তিনটি চেনী(ধারালো দা বিশেশ)বেশ কয়েক গোছা পাটের পাকানো রশি নিয়ে গাছে উঠেন রহম আলী। হাতে ধরা থাকে বাশের দুইহাত লম্বা একটা লাঠি । গাছের নির্দিষ্ট অংশে উঠে সেই লাঠিকে গাছের সাথে স্ট্যান্ডের মত বেঁধে নিজে এর উপর দাঁড়ায়। তারপর গামছা দিয়ে নিজের শরীর কে ঢিলেঢালা করে বাঁধে । এরপর খেজুর গাছের ডাল কাটতে আর কোন সমস্যা হয় না । তবে এই বৃদ্ধ বয়সে গাছে উঠাই বড় সমস্যা। কিন্তু রহম আলীদের সেদিকে খেয়াল দিলে কি চলে?
সকালবেলা শীতের দিনে গ্রামে সবার বাড়িতেই কম বেশী পিঠা তৈরি হয়। উল্লেখযোগ্যে ভাপা পিঠা। গরম গরম ভাপা পিঠা খেজুরের রস দিয়ে খেতে দারুন স্বাদ লাগে। এছাড়া আরো হরেক রকমের পিঠা বানায় যে যার সাধ্যমত।জয়নাব মীর বাড়ির গোমস্তা কাকার কাছ থেকে চেয়ে কিছু চাউল এনেছে। সেই চাউল ভিজিয়ে গতকাল চাউলের গুড়ো বানিয়েছে , পিঠা বানানোর জন্য। সকাল বেলা মেয়ের তৈরি গরম পিঠা খেয়ে রহম আলী রস নামাতে দেয় ছূট। দুইখান পিঠা অতি যত্নে রেখে দেয় জয়নাব কারো জন্য।
জয়নবের মনে ইদানিং বেশ রঙ লেগেছে। সারাদিন মায়ের শাড়ী পরে থাকে । বাড়ির পাশের বিভিন্ন ফুলের গাছ থেকে ফুল এনে খোঁপায় লাগায়। গুনগুন করে গান গায়। বাবাকে আজ লাল কাঁচের চুড়ি আনতে বলেছে , সাথে লাল ফিতা । রহম আলী এখন মোটামুটি ভালই কামাচ্ছে। প্রতিদিনে খেজুর গাছে যে রস হয় তার অর্ধেক গৃহস্ত নেয় বাকী অর্ধেক রহম আলীর । প্রতি দিন মাটির কলসে পাঁচ ছয় কলস হয় । প্রতি কলস গঞ্জে পঞ্চাশ টাকা দরে বিক্রয় করে। সেই কারনে মেয়ের আবদারে রাগ না করে বরঞ্চ খুশী হয়েছেন। গঞ্জ থেকে ফেরার পথে মেয়ের জন্য চুড়ি আর লাল ফিতা কিনে নেন। বহুদিন খাসীর মাংস খাওয়া হয়না , কি মনে করে এক কেজী খাসীর মাংস কিনে নেন। মেয়ের জন্য সুগন্ধি এক শিশি তৈল নিতে ও ভুলেননা।
বাড়িতে প্রবেশের সময় রহম আলী দেখেন , পাশের গ্রামের মমিন মিয়ার ছেলে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা তিনি আঁচ করতে পারেননি। আজিজ রহম আলী কে দেখে থতমত খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে
চাচা আপনের কাছে আইছিলাম।
কেনরে ?
চাচা আইজ রাইতে রস লাগব। পোলাপাইনে শিরনী খাবে।
আজিজ মিয়া গ্রামের ছেলেদের মাঝে মাঝে রস দেন । যাতে করে ছেলেরা তার রসের হাড়ি না ভাঙ্গে। বললেন
ঠিক আছে দিমুনে। কহন লাগব।
আইজ রাইত দশটায়।আমি আমুনে আপনের লাইগ্যা।
না। তোয়ার অয়াইয়্যেনের (আসার) দরকার নাই। আমি নিজেই আইমু।

বসন্তে
প্রকৃতি সেজেছে নতুন রুপে । শীতে পত্র ঝরা সকল বৃক্ষে সবুজের সমারোহ।রুক্ষ প্রকৃতি যেন প্রান ফিরে পেয়েছে। ফুল গাছে নানা রঙের ফুল বাংলার গ্রাম যেন এক স্বর্গপুরী । কোন শিল্পীর আঁকা ছবির মত। শীতের আমেজ শেষে সকলে নানা কাজে ব্যাস্ত।
গ্রামের রাস্তার দু'পাশে বৃক্ষ রাজি সবুজের ছটায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ তৈরি করেছে অবলীলায়। নিরঞ্জন বরাবরই প্রকৃতি প্রেমী মানুষ । সকালে মীর'দের জমিন গুলো প্রাত ভ্রমণের সময় দেখে নেন। কোনটায় কি দরকার। মমিন মিয়ার বাড়ির পেছনে মীর সাহেবদের একটি ধানি জমি আছে। সেই জমিতে বেশ ধান হয়। এবছর সে জমি নিরঞ্জন নিজে চাষ না করে আজিজ কে বর্গা দিবে বলে মনে মনে ভেবে রেখেছে। আজিজ ছেলেটা ভাল।
মমিন মিয়াকে কাশতে কাশতে ঘর থেকে বাহির হতে দেখে নিরঞ্জন বাবু থামলেন। নিরঞ্জন কে গ্রামের সবাই মীর বাড়ির গোমস্তা বলে বেশ মান্য করে। নিরঞ্জনকে দেখতে পেয়ে মমিন মিয়া এগিয়ে এল ।
কি খবর কর্তা , হুট করে এদিকে?
এমনি এলাম। তা তোমার খবর কি ? সব ঠিক আছে তো। আজিজের ব্যাপারে কি ভাবছ?
ক্যান আজিজ আবার কি করছে, কি ভাবমু।
আরে পোলা বড় হইছে না , বিয়ে দেওন লাগব না।
ওহ সে কথা। তা বাবু পাত্রী আছে নাকি আপনার জানাশোনায়।একজন তো বিয়ে করে বউ রেখে চম্পট দিয়েছে। তার কোন খোঁজ রাইখে না।
আজিজের ব্যাপারে আমি তোমারে সহযোগিতা করুমনে।
কেমনে?
তোমার বাড়ির পাশের জমিখান এবার আজিজ মিয়ারে বর্গা দিমু, পোলাখান কিন্তু তোমার বহুত ভালা।
তাইলে আমার কওনের কি আছে। আপনি মুরুব্বি হইয়া ,যা করেন তাই মাইন্যা লমু।
সেদিন রাতে নিরঞ্জন রহম আলীর কাছে যায়। সেখানে বেশ আলোচনা করে রাতে নিজের গৃহে ফিরে আসে ।
রহম আলী আবার আশায় বুক বেঁধে নিজের জমিতে কোদাল দিয়ে মাটি খুড়ছে। এবার কলা নয় অন্য কিছু আবাদ করবে। কলা চাষ তাকে সর্বশান্ত করেছে। ছেলেরা এই বৃদ্ধ বাবার খোঁজ নিতে আসে না ।একমাত্র মেয়ে জয়নবকে নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছে। আদৌ একে বেঁচে থাকা বলে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু গতকাল রাতে জয়নবের ব্যাপারে নিরঞ্জন বাবুর আগ্রহের কথা শুনে দারুন খুশী রহম আলি। শেষ পর্যন্ত মেয়েটার একটা ব্যাবস্থা আল্লাহপাক করে দিয়েছেন ।
অশ্বথতলা গ্রামে আজ দুই পাড়ায় বিয়ের বাজনা বাজছে। মাইকে গান চলছে-বধু সেজে কন্যা যখন এলরে............
কলাগাছের গেইট সজানো হচ্ছে। গ্রাম বাংলার এক পুরানো সংস্কৃতি । দুই পাশে দুইটি করে চারটি কলা গাছ দিয়ে এর উপর বাশের মাচানের মত তাতে নানা রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সজ্জিত করে বিয়ের গেইট বানানো হচ্ছে রহম আলীর বাড়ির সামনে। হায়রে কলা গাছ । গেল বছর রহম আলীকে নিঃশেষ করে এবার তার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে শশুর বাড়ি। তবে রহম আলীর আজ কলা গাছের প্রতি ক্ষোভ দেখা গেল না। বরঞ্চ আজ কলা গাছের গেইট তাকে তার পুরানো দিনের কথা মনে করিয়ে দিল।
গাছে গাছে কোকিল ডাকছে, ফুলে ফুলে চারদিক, সেই মধুসময়ে বিয়ে হয়ে গেল জয়নব আর আজিজের। আজিজ যেমন খুশী মনের মত বউ পেয়ে, জয়নাব ও বেশ খুশী গাবুর লোকটাকে স্বামী হিসাবে পেয়ে। পালকিতে করে জয়নব কে নিয়ে যাচ্ছে চার বেয়ারা। সেদিকে তাকিয়ে রহম আলীর দু'চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। সেই অশ্রু কিসের তা বোঝার সাধ্য কার নাই।
পুনশচঃ গ্রাম বাংলার ঋতু চক্রের মতই জীবন চক্র বদলাতে থাকে । গ্রামের সাধারন মানুষ গুলো কোন এক ঋতুতে কাঁদলে অন্য ঋতুতে হাসে । এই হল চক্র , মানে জীবন চক্র। বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারনে অনেক কিছু লেখা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সে জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিরব নিশাচর সর ঋতুর বাংলাদেশ কে নিয়ে বিদেশ থেকে বসে যেভাবে লিখল এই গল্পকার ! আসলেই ইর্ষনীয়... গ্রাম বাংলার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত লেখা আর কি হতে পারে ? চমত্কার লিখনী ভঙ্গী এবং গল্প বিন্যাস !
sakil রওশান জাহান @ প্রিয় নিরব ভাইয়া @ হাসান ফেরদৌস এবং ছোট ভাই @ সামছুল আরেফিন অনেক ধনাবাদ । তোমাদের অভিনন্দন পেয়ে আমি সিক্ত ।
sakil সালেহ মাহ্মুদ ভাইয়া @ রফিকুজ্জামান রনি @ আহমেদ সাবের ভাই আপনাদের অভিনন্দন নত মস্তকে গ্রহন করলাম । আপনাদের ভালোবাসাই ছিল আমার লেখার প্ররনা । ধন্যবাদ
মোঃ শামছুল আরেফিন অনেক অনেক অভিনন্দন ভাইয়া, বিজয়ের ধারা থাকুক অব্যাহত। আরো অনেক অনেক ভাল লিখুন, এগিয়ে যান অনেক দূর সেই কামনা রইল
মাহমুদুল হাসান ফেরদৌস অভিনন্দন শাকিল ভাই
নিরব নিশাচর সময়ের অভাবে আজও অপঠিতই থাকলো... তবে পুন্খানু পুন্খানু পরে মন্তব্য দিব... আফসোস , সময় থাকতে কেন যে আপনার গল্প মিস হয়ে গিয়েছিল বুঝলাম না !
রওশন জাহান সময় সল্পতায় আপনার লেখাটি আগে পড়তে পারিনি l কিন্তু আজ পড়লাম অপূর্ব বর্ণনাময় এক লেখা. ব্লগেও আপনার লেখা পড়ছি. ক্রমেই সুন্দর থেকে সুন্দরতম হচ্ছে আপনার লেখনি. সবসময় তা বজায় থাকুক এই কামনা করছি.
আহমেদ সাবের ভাই শাকিল, অভিনন্দন। খুব খুশী হলাম গল্পে আপনার সেরা পুরষ্কার প্রাপ্তিতে।

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫০ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.৮৭

বিচারক স্কোরঃ ৪.৫৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪